ছয় মাসে পদার্পণ করল চলতি শিক্ষাবর্ষ। এখনো নবম-দশম শ্রেণির পাঠ মূল্যায়ন ‘পদ্ধতি’ নির্ধারণ করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কী হবে ‘মূল্যায়ন পদ্ধতি’? এ নিয়ে সংযোজন-বিয়োজনে চলছে ঘষা-মাজা। এদিকে ষান্মাসিক মূল্যায়নের সময় আসছে। তবে এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই স্কুল শিক্ষকদেরও। ফলে শ্রেণিপাঠে যেন অন্ধকারে হাতড়াচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। এ সুযোগে চটকদার বিজ্ঞাপনের টোপে অভিভাবকরা ঝুঁকছেন অনলাইন-অফলাইন কোচিং আর গাইড বইয়ের দিকে।
গত ৫ মার্চ নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্তকরণ সংক্রান্ত কমিটি’ গঠন করে। এ কমিটির সুপারিশ (অপ্রকাশিত) বিভিন্ন সময়ে খণ্ডাকারে প্রকাশ হচ্ছে গণমাধ্যমে। এ নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা দেয়নি শিক্ষা প্রশাসন। অথচ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) দায়িত্ব পাঠ্যপুস্তক, সিলেবাস, পরীক্ষার প্রশ্নকাঠামো এবং মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রণয়নের।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, নতুন কারিকুলামের একটি মূল্যায়ন পদ্ধতি শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই নির্ধারণ ছিল। এটিকে আরও পরিমার্জন করার জন্য সময় লেগেছে। তবে শিগগির এনসিসিসির (ন্যাশনাল কারিকুলাম কো-অর্ডিনেশন কমিটি) সভায় তা অনুমোদনক্রমে প্রকাশ করা হবে।
এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা জানান, ‘তাদের নিয়মিত ক্লাস হচ্ছে। শিক্ষকরা বিষয়ভিত্তিক অ্যাসাইনমেন্ট দিচ্ছেন। তবে ক্লাসে শিক্ষকরা ধারণা দিতে পারছেন না, কোন বিষয়ে কীভাবে পড়তে হবে। পরীক্ষার ধরন কী হবে? বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকার কাটিং নিয়ে ক্লাসে আসেন তারা।’
অপরদিকে শিক্ষকরা জানান, ‘আগে শিক্ষাবর্ষের শুরুতে সিলেবাস দেওয়া হতো। পরীক্ষার প্রশ্নের ধারণা দেওয়া থাকত। এ বছর নতুন কারিকুলাম, এ নিয়ে তেমন ধারণা পাচ্ছি না। আবার পরীক্ষা কোন পদ্ধতিতে কীভাবে হবেÑ এখনো কিছুই আমাদের জানানো হয়নি। যতটুকু পারছি পত্রিকা দেখে একটা অনুমান করে বাচ্চাদের শিখতে দিচ্ছি।’ শিক্ষকরাও প্রশ্ন তোলেনÑ ছয় মাস লাগে একটা মূল্যায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ করতে? কারণ বর্তমানে যেসব শিক্ষার্থী নবম শ্রেণিতে পড়ছে, তাদের বছরের পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে। এরাই প্রথমবারের মতো নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে।
অভিভাবকদের অভিযোগ, শ্রেণিপাঠে যখন ধোঁয়াশায় শিক্ষার্থীরা, তখন কোচিং আর গাইডেই যেন তাদের ভরসা।
অভিভাবকদের চাহিদা থাকায় সোশ্যাল মিডিয়ায় চটকদার বিজ্ঞাপন দিচ্ছে বিভিন্ন গাইড বই ব্যবসায়ী এবং অনলাইন-অফলাইন কোচিং সেন্টারগুলো। তাদের টোপ গিলছেন অভিভাবকরা। অথচ নতুন কারিকুলামে গাইড বইয়ের প্রয়োজন নেই। বন্ধ হবে কোচিং বাণিজ্যÑ এমন বক্তব্য দিয়ে আসছেন শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। বাস্তবে দৃশ্যপট ভিন্ন। এ নিয়ে মাঠে কোনো তদারকি নেই শিক্ষা প্রশাসনের।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষাক্রমে যদি কোনো পরিবর্তন আনতেও হয়, দুই-তিন বছর আগে থেকে তার প্রস্তুতি নিতে হবে। এখন ক্লাস চালু করে দিয়ে মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে ঘষা-মাজা চলছে, শিক্ষা একটা গুরুত্বপূর্ণ খাত। এটা নিয়ে খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ নেই। আমার পরামর্শ হচ্ছেÑ মূল্যায়নটি দ্রুত চূড়ান্ত করতে হবে। এ বিষয়ে শিক্ষকদের স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। মূল্যায়ন সম্পর্কে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদেরও জানতে হবে।
জানা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রমের পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর মাধ্যমিক পরীক্ষায় লিখিত অংশে নম্বর বাড়ানো হচ্ছে। নতুন পাঠ্যক্রমে ‘পরীক্ষা’ নেই, ‘নম্বর’ নেই। শিক্ষার্থীরাও কিছু শিখছে না। লেখাপড়া থেকে দূরে যাচ্ছে ছেলেমেয়েরাÑ এমন সব অভিযোগ অভিভাবকদের। এই পাঠ্যক্রমের বিরোধিতা করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা-সমালোচনা করছেন তারা। প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ পর্যন্ত করে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কাছে আটকও হয়েছেন কতিপয় অভিভাবক। এরপর শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে ওই কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
কমিটির সুপারিশ হচ্ছে- নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী এসএসসি পরীক্ষার সামষ্টিক মূল্যায়নের লিখিত অংশের ওয়েটেজ (গড় ভারিত্ব) হবে ৬৫ শতাংশ। আর কার্যক্রমভিত্তিক অংশের ওয়েটেজ ৩৫ শতাংশ। মোট ৫ ঘণ্টায় হবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষার ফলও জিপিএর ভিত্তিতে হবে না। মূল্যায়নের সূচক সাতটি।
উল্লেখ্য, গত বছর থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন এ শিক্ষাক্রম শুরু হয়। আর চলতি বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতেও চালু হয়েছে এ শিক্ষাক্রম।