পবিত্র রমজান মাসের এখনো প্রায় দুই মাস বাকি। অথচ এরই মধ্যে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ছোলা, ডাল, আটা, খেজুর ও মসলার বাজার। তাঁতিয়ে আছে ভোজ্যতেল, চাল, পেঁয়াজ, রসুন, আলু, মুরগি ও ডিমের বাজারও। প্রতিবছর রোজার মৌসুমে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও এবার অনেক আগেই দাম বাড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই প্রতিকেজি ছোলায় ১০ টাকা, মুগ ডালে ৪০ টাকা, আটা-ময়দার প্যাকেটে ৫ টাকা, খোলা পাম তেলে ৭ টাকা দাম বেড়ে গেছে। পাইকারি বাজারে খেজুরের দাম লাফিয়ে বাড়ছে। পিছিয়ে নেই চিড়া-মুড়িও। অল্প দিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি পণ্য দুটিতে ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মূল্যবৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীদের রয়েছে নানা অজুহাত। আর রোজার আগে বাজারদরের এমন ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় দুশ্চিন্তা বাড়ছে ভোক্তাদের।
রোজায় নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের মজুদ ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছে সরকার। পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার
প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নবনিযুক্ত মন্ত্রীদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘পবিত্র রমজান ঘনিয়ে আসছে, তাই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন। কারণ, এ মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ানো উচিত নয়।’
এ দিকে রোজাকে সামনে রেখে দেশে যাতে ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুরের কোনো ঘাটতি না হয় সে জন্য এসব খাদ্যপণ্য বাকিতে আমদানির সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি ভোগ্যপণ্য আমদানিতে পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহ রাখাসহ শূন্য মার্জিনে এলসি খোলা এবং কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানোর বিষয়েও ভাবা হচ্ছে। কিন্তু বাজারে ইতোমধ্যেই ছোলাসহ অনেক পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে।
আমদানি কমের অজুহাতে রাজধানীর খুচরা বাজারে এরই মধ্যে ছোলার দাম বেড়ে প্রতিকেজি মান ভেদে ১০০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে যা পনেরো দিন আগেও ৯০ টাকাতে পাওয়া গেছে।
গত দুই সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়ান ছোলার ৫০ কেজির বস্তাপ্রতি ৪০০ টাকা দাম বেড়ে গেছে। মুগ ডালের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। সপ্তাহ দেড়েক আগে ১৩০ টাকায় বিক্রি হওয়া মুগ ডালের কেজি এখন ১৭০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। মসুর ডালের বাজার আগে থেকেই চড়া। সরবরাহ কম থাকায় দাম বাড়তি।
বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কোম্পানিগুলো আটা-ময়দার প্যাকেটে ৫ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছে। সয়াবিন তেলের বোতল ১৬৯ টাকা থেকে বেড়ে ১৭৩ টাকা হয়েছে। গত বিশ দিনে খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বেড়ে যথাক্রমে ১৭০ টাকা এবং ১৩৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আগে যা ছিল যথাক্রমে ১৬৫ টাকা এবং ১৩২ টাকা। দেশি পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমে ৯০ টাকায় নেমেছে। কিন্তু সপ্তাহ দেড়েকের ব্যবধানে চীনা রসুনের দাম ১৯০ টাকা থেকে বেড়ে ২৫০ টাকা হয়েছে। আদার দামও বেড়েছে।
রোজাকে সামনে রেখে কিছুদিন চিড়া-মুড়ির দামও বাড়ছে। তিনি বলেন, চিড়া কেজি এখন কেনা পড়ছে ৭০ টাকা এবং বিক্রি করছি ৮০ টাকা। ১০-১২ দিন আগেও ৬৬-৬৭ টাকা কিনে ৭৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছি।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে রোজায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চিত্র। সংস্থাটির হিসাব বলছে, গত এক মাসের ব্যবধানে ছোলায় ২ দশমিক ৭৮ শতাংশ, মুগ ডালে ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ, অ্যাংকর ডালে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ দাম বেড়েছে। একই সময়ে আটার প্যাকেটে ৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ, সয়াবিনের ১ লিটার বোতলে ১ দশমিক ৪৮ শতাংশ দাম বেড়েছে। এছাড়া সরু চালে ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ, রসুনে ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ, আলুতে ১০ শতাংশ, ফার্মের ডিমে ৪ দশমিক ৮২ শতাংশ ও ব্রয়লার মুরগিতে ১৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ দাম বেড়েছে। গরম মসলার দাম (এলাচ, লবঙ্গ ও দারুচিনি) ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেড়েছে।
রোজা এলেই দাম বেড়ে যাওয়া যেন রীতিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে রোজার অনেক আগেই দাম বাড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
দাম বৃদ্ধির পেছনে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার প্রবণতাই দায়ী বলে মনে করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, যে কোনো অজুহাতে অল্প সময়ে অনৈতিকভাবে অতিরিক্ত মুনাফা করার প্রবণতা ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা নৈতিক ব্যবসা করছেন না। অপর দিকে রমজানে নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে সেগুলো আরও আগে থেকে নেওয়া দরকার। রোজাকে সামনে রেখে এখনই মনিটরিং জোরদার, সরবরাহ বাড়ানো এবং শুল্ক ছাড় দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি টিসিবির ট্রাক সেলের মতো প্রয়োজনীয় পণ্য সরকার সরাসরি ভোক্তাদের সরবরাহ করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, রোজার অনেক পণ্য আমদানিনির্ভর। আমদানির ক্ষেত্রে ডলারের সংকট যাতে না হয়, প্রাপ্যতা যেন থাকে। তাছাড়া ডলারের দাম বাড়ায় শুল্কের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকার শুল্ক-কর কমাতে পারে। এতে দাম অনেকটা কমে আসবে।
মূল্যস্ফীতি কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দিয়ে তিনি আরও বলেন, আমাদের সবার আগে মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। সরকারি হিসেবে যে মূল্যস্ফীতি রয়েছে তার চেয়ে বেশি চাপ অনুভব করছেন স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা। এ জন্য, আমাদের মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় নজর দিতে হবে।
রোজার আগে বাজারে উত্তাপ বাড়ার পেছনে ব্যবসায়ী ও ভোক্তা-উভয়কেই দায়ী বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা নৈতিক ব্যবসা করছেন না। আর ভুক্তভোগী অর্থাৎ ভোক্তারাও দায়িত্বশীল আচরণ করছেন না। ভোক্তারা অহেতুক অতিরিক্ত পণ্য কিনে বাজার অস্থির করে তুলছেন। রোজার সময় দ্রব্যমূল্যের অস্থিরতা থেকে পরিত্রাণ পেতে ব্যবসায়ী ও ভোক্তা উভয়কেই দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে আমরা যে পদক্ষেপগুলো অবলম্বন করি, সেগুলোর সবই কার্যকর নয়। অভিযান চালালেই সমাধান মেলে না। নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গেও আমার এ বিষয়ে কথা হয়েছে। তাকে বলেছি উৎপাদন, মজুদ, সরবরাহ নিয়ে সরকারি অধিদপ্তরগুলো যে পরিসংখ্যান দেয় তা পুরোপুরি সঠিক নয়। প্রকৃত পরিসংখ্যান দরকার। পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সেটাই হচ্ছে প্রকৃত মনিটরিং। তারপর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। অবশ্যই আগেভাগে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। দেরিতে নিলে তা কাজে আসে না।
সাধারণত বছরে বা মাসিক যে চাহিদা থাকে, রমজানে সেটা দ্বিগুণ হয়ে যায়। অপরদিকে সারা বছরে খেজুরের যে চাহিদা, সেটার অর্ধেকটাই রমজানে। খেজুরের পাইকারি বিক্রেতারা জানান, রোজার জন্য খেজুরের সিংহভাগই ইতোমধ্যে আমদানি হয়ে গেছে। তবে দাম অনেকখানি বাড়তি রয়েছে। সাধারণ মানের খেজুরের দামই অন্তত ২৫ শতাংশ বেশি রয়েছে।
রোজায় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় খোলা বস্তার খেজুর। সেটার বস্তা (৫০ কেজি) প্রতি দাম এবার অন্তত ৫০০ টাকা বাড়তি। সাধারণ মানের এই খেজুরের দাম পাইকারিতেই ১২০ টাকা কেজি থেকে বেড়ে ১৫০ টাকা হয়ে গেছে।
ডলার সংকটের কারণে আমাদের মতো ছোট আমদানিকারকরা বেশির ভাগই এবার এলসি খুলতে পারেননি। তাই বড়দের কাছ থেকে খেজুর সংগ্রহ করেছি। এক হাত বেশি বদলানোয় দামও বেড়ে গেছে।
এদিকে সম্প্রতি চালের বাজারে, বিশেষ করে সরু চালের বাজারে বস্তা প্রতি (৫০ কেজি) ১০০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়তি রয়েছে। আলুর কেজি এখনো ৬০ থেকে ৭০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। চিনির কেজি ১৪৫ টাকা। নতুন করে বেড়েছে মুরগি ও ডিমের দাম। ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়ে ২০০ টাকা ছুঁই ছুঁই এবং ফার্মের বাদামি ডিমের দাম বেড়ে প্রতি ডজন ১৪০ টাকা হয়েছে। খুচরা বিক্রেতারা জানান, পাইকারিতেই প্রতি পিস ডিমের কেনা দাম ৯ টাকা ২০ পয়সা থেকে বেড়ে সম্প্রতি ১০ টাকা ২০ পয়সা হয়েছে।