
মু. রিয়াজুল ইসলাম লিটন: দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগ মুহুর্তে গতকাল দিনাজপুর-২ (বিরল বোচাগঞ্জ) আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোঃ মাহবুব আলম (লাঙ্গল) সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। এ নিয়ে সারা দেশে জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো প্রার্থীর সংখ্যা দাড়ালো ১১জনে। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর কারন হিসাবে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এই নির্বাচনটা যে পুরোপুরিই একটা সমঝোতার নির্বাচন, সেই উপলব্ধি থেকে এবং মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মী, ভোটারদের বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন এবং এই নির্বাচনের ফলাফল সঠিক ভাবে ঘোষনা করা হবে কিনা এসব মতামতের ভিত্তিতে আমি চিন্তা করে দেখলাম যে, এই নির্বাচনে থাকার আর কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। তাই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
এ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির অন্তত ১১ জন প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার ও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ফলে এসব প্রার্থীদের আসনে তাদের সব ধরণের প্রচারণাও বন্ধ রয়েছে। তারা বলছেন, সারা দেশে ৩০০টি আসনে প্রার্থী দেয়ার সক্ষমতা থাকার পরও কেন্দ্রীয়ভাবে ২৬টি আসনের সমঝোতা করে নির্বাচনে আসার সিদ্ধান্ত জাতীয় পার্টির জন্য সঠিক ছিল না। সমঝোতার মাধ্যমে ২৬টি আসন ছেড়ে দেয়া এসব আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এসব আসনের বাইরে যারা জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে দাড়িয়ে ভোটারদের কাছে ভোট চাইতে যাচ্ছেন তাদের নানান ধরনের কথা শুনতে হচ্ছে।
নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো প্রার্থীদের গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকেই স্থানীয় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে নেতাদের দু-এক জনের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের খবর আসতে থাকে। গত ১৭ই ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছালাউদ্দিন খোকা মোল্লা মনোনয়নপত্র বাতিল করেন। এদিন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন ঢাকা-১৩ ও ১৪ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী শফিকুল ইসলাম সেন্টু-ও। গত ২২শে ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের প্রার্থী জাকির হোসেন নির্বাচনে না লড়ার ঘোষণা দেন। গত ৩১শে ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বরিশালের দুটি আসনের প্রার্থী এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ইকবাল হোসেন তাপস নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। তিনি বরিশাল-২ ও বরিশাল-৫ আসন থেকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে লড়ছিলেন। ডিসেম্বরের শেষ দিনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন গাজীপুর-১ ও ৫ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন। তিনিও এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই ঘোষণা দেন। গত ৩১শে ডিসেম্বর বরগুনা-১ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী খলিলুর রহমান নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন নাটোর-৪ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও দলের জেলা সভাপতি আলাউদ্দিন মৃধা। এছাড়া চুয়াডাঙ্গা-৪ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী সোহরাব হোসেনও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। হবিগঞ্জ-২ আসনের জাপা প্রার্থী শংকর পালও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ২রা জানুয়ারি গাজীপুর-৪ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী সামসুদ্দিন খানও সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
সর্বশেষ গতকাল ২রা জানুয়ারি ২০২৪ দিনাজপুর-২ (বিরল বোচাগঞ্জ) আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোঃ মাহবুব আলমও (লাঙ্গল) সংবাদ সন্মেলন করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের অনেকেই বলেছেন, শুরু থেকেই জাতীয় পার্টির ‘সমঝোতার’ মাধ্যমে নির্বাচনে যাওয়ার বিপক্ষে ছিলেন তারা। এ পর্যন্ত যে প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন, তারা সবাই জাতীয় পার্টির জন্য আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেয়া ওই ২৬টি আসনের বাইরের আসনগুলোর প্রার্থী। কিন্তু ওই ছেড়ে দেয়া আসনগুলো থেকে এখনো কেউ সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেননি। ১লা জানুয়ারি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের রংপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন যে, নির্বাচনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি থাকবেন কি না তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তখন তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির কোন প্রার্থী যদি নির্বাচন করতে না চায় তাহলে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা ওই প্রার্থীর রয়েছে। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো প্রার্থীরা বলছেন, একজন নেতা হিসেবে তারা চেয়েছিলেন একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক এবং জাতীয় পার্টি ৩০০টি আসনে নির্বাচন করুক। কেউ বলেছেন, তারা এলাকায় গিয়ে দেখতে পেয়েছেন, যে সব আসনে সমঝোতা হয়েছে, সে সব আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা তাদের পোস্টারে নিজেদের মহাজোটের প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী বলে উল্লেখ করেছেন। কোনও কোনও প্রার্থী জয় বাংলার শ্লোগান এবং শেখ হাসিনার ছবিও পোস্টারে দিয়েছে। কেউ কেউ সমঝোতা’র বাইরে থাকা আসনে নির্বাচন করে জয় পাওয়ার সম্ভাবনার বিষয়ে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তবেই জয়-পরাজয়ের প্রকৃত সিদ্ধান্ত আসে। কিন্তু সমঝোতার কারনে নির্ধারিত তো হয়েই গেছে যে, আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী যারা, তারাই মাঠে সুবিধা পাবেন। সুতরাং এসব জায়গায় সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে, সেটা আশা করা খুব কঠিন। কেউবা মনে করেন, তাদের আসনে যে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা রয়েছেন, তাদের তুলনায় একটি অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়বেন তারা। কোন কোন প্রার্থীরা নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে উল্লেখ করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো প্রার্থীরা বলেন, একে তো নির্বাচন করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার উপর নিজ দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন কেউ কেউ। নির্বাচন নিয়ে কোন ধরনের সহায়তাও পাননি। তাদের সাথে কোনও রকমের যোগাযোগ না করার কথাও উঠেছে। নেই কোন ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট, ফোন দিলেও ফোন ধরে না। নানাবিধ কারণে মাঠ পর্যায়ে তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে বলেছেন কেউ কউ। দলীয় নেতা যদি অন্তত পক্ষে উত্সাহ, সাহস না দেয়, তাহলে টিকে থাকা যায় না। এজন্য মাঠ থেকে তারা পিছিয়ে এসেছে। আগের নির্বাচনগুলোতে দলের কেন্দ্র থেকেই নির্বাচনী নানা ধরনের সরঞ্জাম ও সহায়তা পাঠানো হতো। এবার তার কিছুই করা হয়নি। কেন্দ্র থেকে কোনো খোঁজ-খবর কেউ নেয়নি। সমঝোতার আসনগুলোর প্রার্থীরা আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। তাহলে আমরা কী লিখবো? এসবের উপর ভিত্তি করে নিজেদের নিশ্চিত পরাজয় জেনে শুধু শুধু ট্যাকা-পয়সা খরচ করতে যেমন রাজি হননি তেমনি নিজের কর্মীদের নিয়ে বেকায়দায় ফেলতে চাননি অনেকে। জাপার তৃণমূল নেতাদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় নেতারা তাদের পাত্তাই দিচ্ছেন না। এরকম নানাবিধ সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে নির্বাচন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো প্রার্থীরা। অনেকে মনে করেন, জাতীয় পার্টি ২৬টি আসন নিয়ে আওয়ামী লীগের সাথে যে সমঝোতা করেছে সেটা অনেক নেতাকর্মী মেনে নেননি এর সংগে একাত্মবোধও প্রকাশ করতে পারেনি। কারণ সমঝোতার এসব আসনের বাইরে যেসব আসন রয়েছে সেগুলো নিয়ে জাতীয় পার্টির আসলে কোনও মাথাব্যথা নেই।
এহেন অবস্থা থেকে জাতীয় পার্টির তৃণমূলের নেতারা যে বার্তাটি পেয়েছে সেটি হচ্ছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে আসলে তৃণমূল নেতাকর্মীদের কোন মূল্য নেই। তাদের কাছে মূল্য হচ্ছে যে চুক্তি বা সমঝোতা আওয়ামী লীগের সাথে হয়েছে সেটির। এর মধ্যে দিয়ে যারা সমঝোতা হওয়া আসনের বাইরে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে, সেসব নেতাকর্মীদের মাঝে এক ধরণের বঞ্চনা, অবহেলিত বোধ তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। নেতাকর্মীদের সমর্থনের জায়গা যদি জাতীয় পার্টি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হারিয়ে ফেলে, সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক ভিত্তি ভবিষ্যতে অনেকটাই কমে নড়েবড়ে হয়ে যেতে পারে।
এ জাতীয় আরো খবর..