পাকিস্তান ও ইরান একে অন্যের ভূখণ্ডে নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছে। এমন এক সময় দুই প্রতিবেশী ‘বন্ধুদেশের’ মধ্যে এ উত্তেজনা বাড়ল, যখন ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্য।

পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। একদিকে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশ, অন্যদিকে ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশ। দুই দেশই দীর্ঘকাল ধরে সীমান্ত এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়ছে। দুই পক্ষের শত্রু অভিন্ন হলেও একে অন্যের ভূখণ্ডে হামলার ঘটনা বিরল। গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের মিত্রদের প্রতিরোধের মধ্যে এ পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটল।

গতকাল বৃহস্পতিবার সিএনএনের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে আকস্মিক পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলা করে বসে ইরান। এতে দুই শিশু নিহত হয়; আহত হন কয়েকজন। ইরান দাবি করে, তারা পাকিস্তানে ‘ইরানের সন্ত্রাসী’দের লক্ষ্য করে এ হামলা চালিয়েছে; কোনো পাকিস্তানিকে লক্ষ্যে পরিণত করা হয়নি। কিন্তু এ হামলা পাকিস্তানে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়। এটাকে তারা ‘আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন ও পাকিস্তান-ইরান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মূল ভাবাবেগের বিরুদ্ধে’ বলে মন্তব্য করে। ইরানের হামলার দু’দিন পর বৃহস্পতিবার হামলা চালায় পাকিস্তান।

ইরানের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বার্তা সংস্থা তাসনিম বলছে, তাদের হামলার লক্ষ্য ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি সংগঠন জয়শ আল-আদল। সংগঠনটি সীমান্তের দুই পাশেই তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে তারা ইরানে বেশ কয়েকটি হামলার দায় স্বীকার করেছে। সংগঠনটি সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশের স্বাধীনতা দাবি করছে।

পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বেলুচ জনগোষ্ঠীর বাস। তাদের একাংশ দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতার দাবি করে আসছে। এর জেরে ওই অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী একাধিক গোষ্ঠীর উত্থান হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, জয়শ আল-আদল ইরানে সক্রিয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর একটি। এটি জুনদাল্লাহ নামের বড় জঙ্গি সংগঠনের একটি শাখা। ২০১০ সালে সংগঠনটির নেতাকে ফাঁসি দেয় ইরান।

জয়শ আল-আদলকে এরই মধ্যে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বলে ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সংগঠনটি ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা, বেসামরিক লোকজনকে টার্গেটে পরিণত করে। ২০১৫ সালে ইরানের আট সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে হত্যার দায় স্বীকার করে তারা। অভিযোগ রয়েছে, তারা পাকিস্তান থেকে ইরানে প্রবেশ করে এ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল।

২০১৯ সালে সিস্তান-বেলুচিস্তানে একটি বাসে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ইরানের সামরিক বাহিনীর ২৩ সদস্য নিহত হন। হামলার দায় স্বীকার করে জয়শ আল-আদল। পাকিস্তানে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার একদিন পর বুধবার সিস্তান-বেলুচিস্তানে ইরানের সামরিক বাহিনীর বাসে আরেকটি হামলার দায় স্বীকার করে সংগঠনটি।

পাকিস্তান-ইরান হামলা-পাল্টা হামলার মধ্যে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশকে শান্ত থাকতে বলছে। বুধবার মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাট মিলার বলেন, পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যাতে যুদ্ধ ছড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য কাজ করছে ওয়াশিংটন। তিনি বলেন, ইরান তিন প্রতিবেশী– পাকিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় হামলা চালিয়ে তাদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ দিনের মিত্র পাকিস্তান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তারা শান্তিপূর্ণভাবে বিষয়টি সমাধান করবেন।

ইরানের হামলার জবাবে পাকিস্তানের পাল্টা হামলা এটাই প্রমাণ করে, পাকিস্তান শুধু কূটনৈতিক উপায়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে না। তবে এটি পরিষ্কার নয় যে, সাধারণ শত্রু জয়শ আল-আদলকে কেন্দ্র করে ইরান ও পাকিস্তান দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে জড়াবে কিনা। হামলার পর দুই পক্ষই বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, তারা উত্তেজনা আরও বাড়াতে আগ্রহী নয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইরানকে ‘বন্ধুদেশ’ বলে মন্তব্য করেছে। সেই সঙ্গে তারা যৌথভাবে সমস্যার সমাধান করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও সপ্তাহের শুরুতে পাকিস্তানকে ‘বন্ধুদেশ’ বলে সম্বোধন করেছেন। এ কারণে তাদের হামলা-পাল্টা হামলা সমানুপাতিক, যার লক্ষ্য জঙ্গিদের ধংস করা।