জাতীয় প্রেসক্লাবে শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলন (শিশির) এবং সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন যৌথভাবে আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা মন্তব্য করে বলেছেন, নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের নামে সরকার প্রজন্ম ধ্বংসের নীলনকশা করেছে। শনিবার (২ ডিসেম্বর) তারা এসব কথা বলেন।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক রাখাল রাহা। এতে আলোচক ছিলেন শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবদুস সাত্তার মোল্লা, অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন, অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান, অধ্যাপক আবদুস সালাম প্রমুখ। সেমিনারে আরো বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আর রাজি ও ঢাবি বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আজম প্রমুখ।
এদিকে জামালপুরে একটি অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, নতুন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে একটি পক্ষ অপপ্রচার চালাচ্ছে। অনেক গবেষণা করে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, দেশে-বিদেশের আধুনিকতার আলোকে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। তিনি বলেন, ২০২৭ সাল পর্যন্ত সব পর্যায়ে এই আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হবে। ২০১৯ সালে এটা চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়।
অন্যদিকে ঢাকায় ‘পরিকল্পিত শিক্ষাধ্বংসের কালপঞ্জী: ১৯৭২-২০২২’ শীর্ষক সেমিনারে রাখাল রাহা মূল প্রবন্ধে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের নামে প্রজন্মকে ধ্বংসের নীলনকশা করা হয়েছে। এর প্রতিবাদ করাই অভিভাবক-শিক্ষকসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
তাদের মুক্তি দাবি করে তিনি বলেন, গ্রেফতার চারজন কিন্তু কোনো চুরি ডাকাতি বা কারও সম্পত্তি লুট করেননি। তারা কোনো ব্যাংক ডাকাতি করেননি। তাহলে কেন তাদের গ্রেফতার করা হলো? নতুন কারিকুলামের নামে নতুন প্রজন্মকে ধ্বংসের যে নীল নকশা করা হয়েছে, তার প্রতিবাদ করার কারণেই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত যে কয়টি শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ও বাস্তবতাবিবর্জিত শিক্ষাক্রম হলো নতুন শিক্ষাক্রম। এ শিক্ষাক্রমের ফলে দেশে নিম্নমানের প্রচুর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সৃষ্টি হবে। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বাইরে চলে যাবে।
নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠদান পদ্ধতি ও পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজিম উদ্দিন খান বলেন, নতুন শিক্ষা পদ্ধতিতে এমসিকিউর মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তোতা পাখি হিসেবে তৈরির চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, পঞ্চম শিল্পবিপ্লবের নামে শিক্ষার্থীদের রোবটিক মানুষ তৈরির পরিকল্পনা চলছে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে শ্রম দিয়ে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারি। এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থার সংক্রমণ চলছে, যার শেষ পর্যায়ে আমরা চলে এসেছি। সামগ্রিকভাবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা ছাড়া আর কিছুই দেখছি না।
শিক্ষকদের বিষয়ে তিনি বলেন, শিক্ষায় যত পরিবর্তনই আনা হোক, শিক্ষকদের মান নির্ধারণ করা না গেলে কোনো শিক্ষাব্যবস্থা কার্যকর করা যাবে না। ঢাবি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন বলেন, কোনো মানুষের নাম শুনলে মনের ভেতর যেমন তার চেহারার একটি প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে, তেমনটি প্রতিটি শব্দের একটা চেহারা আছে। প্রতিটি দেশের শিক্ষার্থীরা তাদের নিজের মাতৃভাষায় পড়ালেখা করে। বর্তমানে আমাদের যে শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে, এতে শিক্ষায় বরাদ্দ কমার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার দিকে ধাবিত হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংরেজি শিক্ষার ব্যবসার প্রসারের লক্ষ্যেই এই শিক্ষাব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
এদিকে, পাঠ্য বইয়ে কোমলমতি শিশুদের মেধা, শিক্ষা ও নৈতিকতা ধ্বংসকারী শিক্ষা কারিকুলাম বাতিলের দাবি জানিয়েছে সচেতন অভিভাবক সমাজ। শনিবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধনে এই দাবি জানিয়ে অভিভাবকরা বলেন, নতুন কারিকুলামে ৬ষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার নামে যা শেখানো হচ্ছে, তা স্পষ্ট ‘যৌন শিক্ষা’। এই যৌন শিক্ষা পাঠ বাতিল করতে হবে। বিশেষ করে, ৬ষ্ঠ শ্রেণির এ শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ৪৭ থেকে ৪৯ পৃষ্ঠায় বয়ঃসন্ধিকালে নারী-পুরুষের দেহের পরিবর্তন, নারী-পুরুষের শরীর থেকে কি নির্গত হয়, কোন অঙ্গের আকার কেমন হয়, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কেমন আকর্ষণ হয় ইত্যাদি শেখানো হচ্ছে।
এছাড়া বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ্য বইয়ের ১১তম অধ্যায়ের ‘মানব শরীর’ শিরোনামে ১১৯ থেকে ১২২ পৃষ্ঠায়- পেনিস, পেনিস দৃঢ়তা, যোনী, লোম গজানো, স্তন, নিতম্ব, উরু, বগল, স্রাব, মাসিক, সেক্স হরমোন, ইত্যাদি রগরগে বর্ণনা সহকারে কোমলমতি শিশুদের পড়ানো হচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগের বিষয়। অভিভাবকরা বলেন, ৬ষ্ঠ শ্রেণির একটা বাচ্চার বয়স কত হয়? ১১ থেকে ১৩ বছর! এই বয়সে সব শিশু বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছায় না। কিন্তু সেই বয়সেই এ ধরনের শিক্ষা বাচ্চার মনে ভয়ঙ্কর কু-প্রভাব ফেলতে পারে। এই শিক্ষাক্রম বাতিলসহ তারা ৯টি দাবি জানান।