নিউজ পরিক্রমা ডেস্ক: ২০০১ সালে যে ১১টি নতুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। সেই তালিকায় ছিল রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে এটিই হল ১ম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি, মানসন্মত আধুনিক ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা, সুসংগত সম্প্রীতি এবং অনুপ্রেরণামূলক ও ব্যতিক্রম ধর্মী এক বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির লক্ষ্যে ২০০১ সালের ১৫ জুলাই জারি করা এক আইনে রাঙ্গামাটি শহর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই লিংক রোডের পাশে ঝগড়াবিল নামক মৌজায় রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। এই আইনটি জারি হওয়ার পরপরই একটি প্রকল্পের অধীনে এর প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করা হয়। এই সিদ্ধান্তের সাথে সামঞ্জস্য রেখে “রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প” ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ তারিখে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণের পাশাপাশি দেশের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে অনুসরণীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়। নির্দেশাবলীর মধ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং বাস্তুসংস্থান রক্ষা করে পাহাড়গুলিকে অক্ষত রেখে ভবন নির্মাণ এবং ভুটানের স্থাপত্য ভাস্কর্য অনুসারে স্থাপত্য নকশা প্রণয়ন করার কথা বলা হয়। এ কারণে ভুটানের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত স্থাপনার আদলে গড়ে তোলা হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্ববিদ্যালয়টির অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্পূর্ণ হলে এটিই বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক ও নান্দনিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে মনে করা হয়। আইনের বিধান অনুযায়ী ২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম চালু হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষনার প্রথম থেকেই এর স্থাপন নিয়ে পক্ষ বিপক্ষে অবস্থান নেয় দুটি গ্রুপ। সর্বদলীয় ছাত্র সমাজ এবং রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন কমিটি উচ্চ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার জন্য এর পক্ষে অবস্থান নিলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সমর্থিত নাগরিক আন্দোলন এর বিরোধীতা করে আন্দোলন কর্মসুচীর হুমকী দেয়, পালন করা হয় হরতালের মতো কর্মসূচি। বিরোধিতাকারীরা ধারণা করেছিল পাহাড়ীদের ভিটে মাটি উচ্ছেদ করতেই একটি মহল রাঙামাটিতে বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই তারা অনতিবিলম্বে এর কার্যক্রম স্থগিত করার দাবী জানিয়েছিল। যার কারণে সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কিছুটা পিছিয়ে পড়ে।
২০১৫ সালে ২টি অনুষদের অধীনে সিএসই, ম্যানেজমেন্ট ২টি বিভাগে ৮৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ৩টি অনুষদে পড়ানো হয় বিজ্ঞান ও বাণিজ্যিক বিষয়। তিনটি অনুষদের অধীনে মোট পাঁচটি বিভাগ চলমান রয়েছে। আরো নতুন নতুন বিভাগ খোলার অপেক্ষায় রয়েছে। যা অবকাঠামো তৈরি হলেই চালু হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় প্রো ভিসি মহোদয়।
চলমান বিষয় গুলোর মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি অনুষদরে অধীনে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ফরেস্ট্রি এন্ড এনভারমেনটাল সায়েন্স বিভাগ।বায়োলজিক্যাল সায়েন্স অনুষদের অধীনে ফিশারিজ এন্ড মেরিন রিসোর্সেস টেকনোলজি বিভাগ এবং বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের অধীনে ম্যানেজমেন্ট ও ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ রয়েছে। শুরুতে রাঙামাটি শহরের শাহ বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে দুটি রুম ভাড়া করে পাঠদান শুরু হয়েছিল। প্রায় ৫ বছর পর ২০১৯ সালে রাঙামাটির ঝগড়াবিল এলাকায় স্থায়ী ক্যাম্পাসে ক্লাস শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে প্রায় সাড়ে আটশোর অধিক শিক্ষার্থীর বিপরীতে ২৮ জন শিক্ষক রয়েছেন। এদের মধ্যে বর্তমানে ৫ জন শিক্ষক রয়েছেন শিক্ষা ছুটিতে।
প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশের দিক থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে এটি। বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাসের নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ না হলেও শিক্ষার্থীদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রায় প্রতিটি বিভাগে পর্যাপ্ত ল্যাব সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। নির্মাণকাজ শেষ হলে বিশ্ববিদ্যালয়টি পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে মাতৃভাষা বাংলা ও ইংরেজি ভাষা বহুল প্রচলিত হলেও রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি এখানে ব্যাপক ভাবে প্রচলিত পাহাড়ি ভাষা। বৈসাবীর কারনে ১লা বৈশাখে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র এক দিনের ছুটি দেয়া হলেও রাবিপ্রবিতে ছুটি দেয়া হয় প্রায় সপ্তাহব্যাপী। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় রাবিপ্রবি সাংস্কৃতিক বৈচিত্রতায় রয়েছে এগিয়ে। নানা , ধর্ম, বর্ণ ও জাতিগত পার্থক্য ও খাবারের বৈচিত্র রয়েছে এখানে। যা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে আলাদা। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত দুটি ব্যাচ স্নাতক ও একটি ব্যাচ স্নাতকোত্তর শেষ করেছে। পাহাড় না-কেটে প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণপূর্বক পাহাড়ের গা-ঘেষে
ক্যাম্পাসে দুটি একাডেমিক ভবন, দুটি প্রশাসনিক ভবন, একটি সেন্ট্রাল লাইব্রেরি এবং একটি ক্যাফেটেরিয়া আছে। আবাসিক সংকটের কারণে কিছু শিক্ষার্থী ঘরভাড়া করে বাইরে থাকছেন। এদের আনা নেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি বাস রয়েছে।
প্রাকৃতিকভাবে এমন পরিপূর্ণ ক্যাম্পাস দেশে মনে হয় আর কোথাও পাওয়া যাবে না। ক্যাম্পাসটি পাহাড়ের কোল ঘেঁষে হওয়ায় এবং উঁচুনিচু পাহাড়ের উপরে অবস্থিত বলে বিশ্ববিদ্যালয়টি উপর থেকে দেখলে নান্দনিক বিশ্ববিদ্যালয় মনে হয়। আচমকা দেখে এটাকে কোনো পর্যটন কেন্দ্রও মনে হতে পারে। পার্বত্য অঞ্চলে এক অপূর্ব মনোরম পরিবেশে অবস্থিত বলে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে ছবির মতো ক্যাম্পাস বলে মনে হয়।