দেশে সাধারণত সেতু পারাপারে যানবাহনের কাছ থেকে টোল আদায় করা হয়। সর্বশেষ, সড়কে যান চলাচলেও টোল আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে টোলের পরিমাণ নির্ভর করবে সড়কের শ্রেণিভেদে। এ ছাড়া ‘টোল সমন্বয়’ শিরোনামে প্রতি বছর নতুন হারেও টোল নির্ধারণ করা হবে। সরকারের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যেই টোল আদায়ের একটি নীতিমালা তৈরি করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
মূলত সড়ক-মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় বহনের লক্ষ্যেই এই টোল বা পথশুল্ক আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতে করে সাধারণ মানুষের যাতায়াত ব্যয়ই শুধু বাড়বে না; পণ্য পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে- তথা আর্থিক প্রভাব পড়বে সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয়েও। যদিও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর ভাষ্য, রাস্তা ভালো থাকলে পণ্য পরিবহন বরং সহজ হবে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত বছরের ৩১ অক্টোবর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের টোল নীতিমালা সংশোধন করে নতুন করে খসড়া প্রস্তুত করেছে সরকার। বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে টোলহার নির্ধারণ পদ্ধতিতে। প্রস্তাবিত নীতিমালা অনুযায়ী ‘টোল সমন্বয়ের’ মাধ্যমে প্রতি বছর নতুন হারে টোল নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে। এতে করে সড়কে টোলপ্রথা চালুর আগেই টোল বৃদ্ধির পথ প্রসারিত করা হলো। নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে- সড়ক-মহাসড়ক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ জোগাতে টোল বা পথশুল্ক আদায় করা হবে।
এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও সড়কে টোল দিতে হয়। এখানেও টোল দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি বছর সমন্বয় করতে হবে। সব কিছুর খরচ বেড়েছে। সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই টাকা আমরা কোথা থেকে পাব? তাই টোল তো দিতেই হবে। তা হলে আরেক দফা পণ্যের দাম বাড়তে পারে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পণ্যের দাম বাড়বে কেন? রাস্তা ভালো থাকলে পণ্য পরিবহন সহজ হবে। তবে পয়সা খরচ হবে সড়ক চলাচলে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের মেইনটেন্যান্স অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন নিডস রিপোর্ট ২০২২-২৩ অনুযায়ী- সড়ক, সেতু ও কালভার্ট মেরামতের জন্য চলতি অর্থবছরে প্রায় ৬ হাজার ২৯৫ কোটি টাকার চাহিদা ছিল। কিন্তু সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ প্রতি বছরই যে আর্থিক চাহিদা দিয়ে থাকে, তা পূরণ করতে পারে না সরকার। তাই চাহিদা পূরণের ভাবনা থেকে সড়কেও টোল আদায়ের নির্দেশনা আসে সরকারের তরফে।
নতুন নীতিমালায় টোলহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে যুক্ত করা হয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের ভোক্তা মূল্যসূচককে। এর ফলে ‘?ভিত্তি টোলে’ কোনো পরিবর্তন ছাড়াই প্রতি বছর বাড়বে টোলহার। এ জন্য খসড়া নীতিমালায় ‘টোলহার নির্ধারণ’ এই শব্দবন্ধকে ‘টোলহার সমন্বয়’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সংশোধিত নীতিমালায় সংযোজন করা হয়েছে সীমান্ত সড়কও।
নতুন নীতিমালায় গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কের ভিত্তি টোল নির্ধারণ করা আছে কিলোমিটারপ্রতি ২ টাকা। একইভাবে জাতীয় মহাসড়কের জন্য কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৫০ পয়সা, আঞ্চলিক মহাসড়কে কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা, সীমান্ত মহাসড়কে ১ টাকা, জেলা মহাসড়কে ৫০ পয়সা ভিত্তি টোল নির্ধারণ করা আছে। এটি হচ্ছে গ শ্রেণির (মিডিয়াম ট্রাক) যানবাহনের ক্ষেত্রে। ক শ্রেণির (ট্রেইলার) ক্ষেত্রে এ হার ২৫০ শতাংশ এবং খ শ্রেণির ক্ষেত্রে (হেভি ট্রাক) ২শ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ঘ শ্রেণিতে পড়েছে বড় বাস এবং ঙ শ্রেণিতে মিনি ট্রাক।
প্রস্তাবিত নীতিমালার টোলহার সমন্বয়ের সূত্র প্রয়োগ করে দেখা গেছে, এটি কার্যকর হলে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের সর্বশেষ প্রকাশিত ভোক্তা মূল্যসূচকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এক্সপ্রেসওয়ে/গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় মহাসড়কের ভিত্তি টোল হবে প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা ৪৩ পয়সা। একইভাবে জাতীয় মহাসড়কে কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৮২ পয়সা, আঞ্চলিক ও সীমান্ত মহাসড়কে কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ২২ পয়সা ও জেলা মহাসড়কের কিলোমিটারপ্রতি ভিত্তি টোল হবে ৬১ পয়সা। সড়কের পাশাপাশি সেতুর ভিত্তি টোলও পৃথকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আদায়কৃত টোল জমা হবে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ তহবিলে। প্রয়োজনে টোল আদায়ে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগের বিষয়টিও যুক্ত করা হয়েছে।
জানা গেছে, টোলের সংশোধিত খসড়া নীতিমালায় ‘টোলহার নির্ধারণের সূত্র’ বাদ দিয়ে ‘টোলহার সমন্বয়ের সূত্র’ সংযোজন করা হয়েছে। নতুন সূত্রটি হলো ‘সমন্বয়কৃত টোল = ভিত্তি টোল + (বর্তমান অর্থবছরের ভোক্তা মূল্যসূচক – ভিত্তি অর্থবছরের ভোক্তা মূল্যসূচক) / ভিত্তি অর্থবছরের ভোক্তা মূল্যসূচক (গুণ) ভিত্তি টোল (গুণ) ০ দশমিক ৩০। টোলহার সমন্বয়ের ক্ষেত্রে ২০১৪ সালকে ভিত্তি অর্থবছরের ভোক্তা মূল্যসূচক হিসেবে বিবেচনা করা হবে। আর বিদ্যমান অর্থবছরের ভোক্তা মূল্যসূচক হিসেবে ধরা হবে সর্বশেষ প্রকাশিত ভোক্তা মূল্যসূচককে।