অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তির (ইপিএ) মাধ্যমে জাপানে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাওয়ার ওপর সর্বোচ্চ জোর দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ইপিএর আওতায় জাপান এদেশে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়াতে চায়। এ কারণে জাপানের সঙ্গে ইপিএ করবে সরকার। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ও জাপান সরকার চুক্তির ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এলক্ষ্যে আরও কয়েকটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবে উভয় দেশ। এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশ ও জাপান লাভবান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। শ্রম অধিকার রক্ষায় জোর দেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের বাণিজ্য নিয়ে জাপানের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। ই-কমার্স খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে চায় তারা।
গতকাল বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) সচিবালয়ে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি সই করতে ‘জয়েন্ট স্টাডি গ্রুপ রিপোর্ট ’ প্রকাশ উপলক্ষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি ও মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বাণিজ্য সচিব জানান, অনেকটা ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট-এফটিএ বা প্রেফিরেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট-পিটিএর আদলে ইপিএ করা হবে।
প্রথমবারের মতো জাপানের মতো একটি উন্নত দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি সই (ইপিএ) নিয়ে এই প্রথম সত্যিকারের কোনো আলোচনা হতে যাচ্ছে। তিনি বলেন, জাপান একটি উন্নত দেশ, অনেক বড় অর্থনীতি, তাদের সঙ্গে আমরা অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি করতে যাচ্ছি। এর আগে শ্রীলঙ্কা ও ভুটানের মতো ছোটখাটো অনেক অর্থনীতির সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি করার আগে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। ২০২৬ সালের পর বাংলাদেশ এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে যাবে। ওই সময় জাপানের মতো উন্নত ও বড় অর্থনীতির দেশের বাজারে শুল্কুমুক্ত সুবিধা নিশ্চিত করতে হলে ইপিএ করা প্রয়োজন। কারণ ইপিএ করা হলে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাওয়া যাবে। তপন কান্তি ঘোষ বলেন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি। তাদের সঙ্গে এ সম্পর্কিত আলোচনায় যাওয়া যায় কি না, আমরা সেই চেষ্টা করেছি।
সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে তিন দফা বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু তা ছিল অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ)। তিনি জানান, জাপানের সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি কেবল বাণিজ্যের মধ্যেই সীমিত থাকবে না, এখানে বিনিয়োগ, সরকারি ক্রয়সহ সেবা খাতেও বিনিয়োগ হবে। ইপিএ থেকে বাংলাদেশের কী সুবিধা অর্জিত হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই বাংলাদেশ এখান থেকে লাভবান হবে। এটি থেকে প্রথমে যে অর্জনটি আসবে, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশী পণ্য তাদের বাজারে শুল্কমুক্তভাবে প্রবেশ করতে পারবে।
২০২৬ সালের পরও জাপানের বাজারে আমরা এই সুবিধা পাব। গত বছর জাপানে রপ্তানি ৪৫ শতাংশ বেড়েছে, যা অনেক উন্নত দেশে আমরা অর্জন করতে পারিনি। জাপান যেহেতু অন্যান্য দেশে বিপুল পরিমাণ ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা এফডিআই করে। আমাদেরও উদ্দেশ্য হচ্ছে গ্লোবাল ভ্যালু চেইন মার্কেটে নিয়ে যাওয়া। তৈরি পোশাক বলি, জুতা বলি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত পণ্যটি রপ্তানি করি। এখনকার আইডিয়া হলো মেকিং দ্য ওয়ার্ল্ড। অর্থাৎ গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে ঢুকতে গেলে বিদেশী বিনিয়োগ লাগবে। আমরা তখন ইন্টারমিডিয়ারি গুডস (মধ্যবর্তী পণ্য) অন্য দেশে রপ্তানি করতে পারব। আমরা তো ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছি, জাপানি বিনিয়োগকারীরা সেই সুযোগ ব্যবহার করতে পারেন। তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারে।
বাণিজ্য সচিব জানান, নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজারে অর্থনৈতিক অঞ্চলের মতো আমরা এমন অনেক অবকাঠামো প্রস্তুত করেছি। সেখানে জাপানি বিনিয়োগকারীদের আলাদাভাবে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে তাদের যদি কোনো সমস্যা হয়, সেটা আলাদাভাবে সমাধানের চেষ্টা করা হবে। কাজেই জাপানের সঙ্গে অংশীদারিত্ব চুক্তি সই নিয়ে আমরা আশাবাদী হতে পারি। তিনি বলেন আগামী এক বছরের মধ্যে আমরা চুক্তি সই করতে পারব। কারণ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের কারণে ২০২৬ সালের নভেম্বরে আমরা সেখানে শুল্কমুক্ত সুবিধা হারাতে যাচ্ছি।
কিন্তু এরই মধ্যে চুক্তি সই হলে, সেটা হারাতে হবে না। এ সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি বলেন, এই চুক্তি থেকে দুইপক্ষ কী পরিমাণ লাভবান হবে, সেটা আগে বলা কঠিন। তবে এটি কেবল শুল্কের সঙ্গেই সম্পর্কিত না, সেবা খাত, বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নতকরণসহ বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। এ চুক্তি থেকে জাপান-বাংলাদেশ দুদেশই লাভবান হবে। ২০২৬ সালের মধ্যেই চুক্তিটি করতে হবে।
জয়েন্ট স্টাডি গ্রুপের রিপোর্টে যা বলা হয়েছে ॥ যৌথ সমীক্ষা প্রতিবেদন বা জয়েন্ট স্টাডি গ্রুপে শ্রম অধিকার নিশ্চিত করার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সদস্য এবং ১০টি মৌলিক কনভেনশনের মধ্যে ৮টি সহ ৩৬টি আইএলও কনভেনশন অনুমোদন করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্রম অধিকার রক্ষার বিষয়টির যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি এবং সর্বশেষ শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি কাঠামো দেওয়া হয়েছে। এতে সর্বনিম্ন বেতন সাড়ে ১২ হাজার করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, শ্রম অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ রোডম্যাপ এবং জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা (২০২১-২০২৬) বাস্তবায়ন করছে। অনলাইন কমার্স বা ই বাণিজ্যে জোর দিয়েছে জাপান।
এলক্ষ্যে জাপানের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ খাতে বিনিয়োগ করবেন জাপানি উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশের আইটি সেক্টর নিয়ে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছে দেশটি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয় ই কমার্স বাণিজ্যকে শক্তিশালী করতে ইতোমধ্যে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ডিজিটাল কমার্স নীতি ২০১৮, ডিজিটাল কমার্স অপারেশন নির্দেশিকা ২০২১, ডিজিটাল ব্যবসা শনাক্তকরণ নির্দেশিকা ২০২১ সম্পন্ন করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজস্ব খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে কাস্টমস অ্যাক্ট ১৯৬৯, মূল্য সংযোজন কর এবং সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১২, ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট ১৯৪৭ করা হয়েছে।